– ড. আহমদ আমীন।
আপনি কি জানেন প্রাকৃতিক রেশম আর কৃত্রিম রেশমের মধ্যে পার্থক্য কী? আপনি কি জানেন বাঘ আর বাঘের ছবির মধ্যে পার্থক্য কী? আপনি কি জানেন বাস্তব জগৎ আর মানচিত্রের জগৎ, জাগ্রত অবস্থায় কাজ করা আর স্বপ্নে কাজ করার মধ্যে পার্থক্য কী? আপনি কি জানেন জীবনের জন্য সংগ্রামী একজন মানুষ আর দোকানে পোশাক প্রদর্শনের জন্য রাখা প্লাস্টারের মূর্তির মধ্যে পার্থক্য কী? আপনি কি জানেন শোকার্ত বিলাপকারী আর ভাড়া করা বিলাপকারী, চোখে কাজল পরা আর কাজলের ন্যায় জন্মগতভাবে চোখের কালো দাগের মধ্যে পার্থক্য কী? আপনি কি জানেন যোদ্ধার হাতে থাকা তলোয়ার আর শুক্রবারের খুতবার সময় খতীব সাহেবের হাতে থাকা কাঠের তলোয়ারের মধ্যে পার্থক্য কী? আপনি কি জানেন জীবনের বাস্তব মানুষ আর সাদা পর্দায় প্রদর্শিত মানুষের প্রতিচ্ছবির মধ্যে পার্থক্য কী? আপনি কি জানেন শব্দ আর প্রতিধ্বনির মধ্যে পার্থক্য কী? যদি এগুলো আপনি বুঝে থাকেন, তবে জানবেন – এটাই সত্য ধর্ম ও কৃত্রিম ধর্মের মধ্যে পার্থক্য।
গবেষকরা তাদের মস্তিষ্ক খাটান, ইতিহাসবিদরা তাদের নথিপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেন—কী কারণে মুসলিমরা তাদের প্রাথমিক যুগে বিস্ময়কর সব সাফল্য অর্জন করেছিল। তারা জয় করেছে, দখল করেছে, নেতৃত্ব দিয়েছে। অথচ পরবর্তী যুগে মুসলিমরা একইভাবে অবাক করা ঘটনাগুলোই ঘটিয়েছে, কিন্তু দুর্বল হয়েছে, পরাধীন হয়েছে, ও হীনমন্যতায় ভুগেছে। অথচ কোরআন এখনও সেই কোরআন, ইসলামের শিক্ষাগুলো এখনও সেই একই, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এখনও সেই “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”। সব কিছু একই রকম, তবুও তারা বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে এ বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করেন। কিন্তু আমি মনে করি এর একটাই কারণ – তা হলো সত্য ধর্ম ও কৃত্রিম ধর্মের মধ্যে পার্থক্য।
কৃত্রিম ধর্ম: নড়াচড়া আর কথার খেলা, এর বাইরে কিছুই নেই।
আর সত্য ধর্ম: আত্মা, হৃদয় এবং তীব্র বিশ্বাসের ধর্ম।
কৃত্রিম ধর্মে নামাজ শুধু শারীরিক কসরত, হজ শুধুমাত্র শারীরিক ভ্রমণ, আর ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান কেবলই নাট্যরূপ বা মঞ্চ প্রদর্শনী।
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” কৃত্রিম ধর্মে শুধু একটি সুন্দর বাক্য, যার কোনো প্রকৃত অর্থ নেই। কিন্তু সত্য ধর্মে এটি সবকিছু। এটি আর্থিক উপাসনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, ক্ষমতার উপাসনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, লালসার উপাসনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং আল্লাহ ব্যতীত সব কিছুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” কৃত্রিম ধর্মে মাথা নত করার, দেহের লালসার কাছে আত্মসমর্পণ করার সাথেও খাপ খায়। কিন্তু সত্য ধর্মে এটি কেবলমাত্র সত্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” কৃত্রিম ধর্মে হাওয়ার সাথে উড়ে যায়, কিন্তু সত্য ধর্মে তা পর্বতসম বাধা সৃষ্টি করে।
কৃত্রিম ধর্ম হলো একটি কারিগরি, যা বুদ্ধিমত্তা এবং অভিজ্ঞতা দিয়ে পারদর্শী হওয়া যায়। কিন্তু সত্য ধর্ম হলো আত্মা, হৃদয় এবং বিশ্বাস। এটি কোনো কাজ নয়, বরং প্রতিটি মহৎ কাজ ও উচ্চমানের কাজের প্রেরণা।
সত্য ধর্ম একটি এমন এক শক্তি যা মৃতকে জীবিত করে তোলে, দুর্বলকে শক্তিশালী করে তোলে। এটি দার্শনিকদের সেই বিখ্যাত পাথর, যা দিয়ে তামা, রূপা বা সীসা সোনায় পরিণত হয়। এটি সেই বিশ্বাস যা অবিশ্বাস্য ঘটনাগুলোর জন্ম দেয়, যার সামনে বিজ্ঞান, ইতিহাস এবং দর্শনও অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
এটি সেই ওষুধ যা সামান্য গ্রহণ করলেই জীবনের সব বিষকে দূর করে দেয়। এটি সেই রাসায়নিক উপাদান যা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতাকে রবের কাছে নিয়ে যায়, জাগতিক কাজে এমনভাবে মিশ্রিত হয় যে তা যেকোনো বাধা দূর করে এবং লক্ষ্য পূরণের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।
সত্য ধর্মই সেই শক্তি যা সফলদের অর্জিত হয়েছে, এবং ব্যর্থদের তা দিয়ে হারানো গেছে। এটি সেই বিদ্যুৎ যা চাকার গতি বাড়ায় এবং কর্মের গতি চালু রাখে; যখন এটি বিচ্ছিন্ন হয়, তখন আর কোনো গতি বা কর্ম থাকে না।
এটি সেই শক্তি যা তারে এসে ধ্বনিত হয় এবং মধুর সুর সৃষ্টি করে, যা আগে ছিল নিছক কিছু দড়ি। এটি শব্দে এসে সুন্দর গান সৃষ্টি করে, যা আগে ছিল শুধুই বাতাস।
সত্য ধর্ম তার অনুসারীকে ধর্মের জন্য বাঁচতে এবং এর জন্য সংগ্রাম করতে শেখায়। আর কৃত্রিম ধর্ম এর অনুসারীকে ধর্মকে ব্যবহার করে বাঁচতে এবং তাতে ব্যবসা করতে শেখায়।
সত্য ধর্মে এর অনুসারী সকল ক্ষমতা ও প্রভাবের ঊর্ধ্বে থাকে, আর কৃত্রিম ধর্ম অনুসারীকে ধর্মকে বাঁকিয়ে ক্ষমতা ও প্রভাবশালীদের খেদমতে ব্যবহার করতে শেখায়।
সত্য ধর্ম হলো হৃদয় এবং শক্তি, আর কৃত্রিম ধর্ম হলো ব্যাকরণ, শব্দের খেলা এবং শব্দের ব্যাখ্যা।
সত্য ধর্ম হলো আত্মা এবং রক্তের মিশ্রণ, অন্যায়ের প্রতি ক্রোধ, সত্যের প্রতি প্রতিশ্রুতি এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য মৃত্যুবরণ। আর কৃত্রিম ধর্ম হলো বড় পাগড়ি, দামী পোশাক, ঝকঝকে জুতো এবং প্রশস্ত হাতা।
প্রতিটি ধর্মের অনুসারীদের বড় অপরাধ হলো সময়ের সাথে সাথে তারা এর আত্মাকে হারিয়ে ফেলে এবং কেবল বাহ্যিক রূপ ধরে রাখে। তারা মূল্যবোধকে উল্টে দেয় এবং আত্মার মূল্য না দিয়ে বাহ্যিক রূপকেই সারা দুনিয়া মনে করে।
“বিশ্বাস” প্রেমের মতো। এটি শীতলতাকে উত্তাপে রূপান্তরিত করে, অলসতাকে উদ্দীপনায় পরিণত করে, দুষ্টতাকে পবিত্রতায় এবং স্বার্থপরতাকে পরার্থপরতায় পরিণত করে।
সত্য বিশ্বাস হলো সেই জাদুকাঠি, যা যেকোনো কিছুকে স্পর্শ করলেই তা জ্বলে ওঠে; যা ঠান্ডা কিছুকে গলিয়ে দেয়, যা মৃতকে জীবিত করে।
আমার যদি এমন কেউ থাকত যে কৃত্রিম ধর্মকে এর সমস্ত উপকরণসহ গ্রহণ করত এবং আমার কাছে সত্য ধর্মের এক টুকরো বিক্রি করত, তবে সেই ধর্মের গভীরতা এবং প্রকৃত অর্থ আমার হৃদয়ে অনুভব করতে পারতাম।
“আমার একটি ক্ষতবিক্ষত হৃদয় আছে,
কেউ কি এমন একটি হৃদয়
বিক্রি করবে যেটা অক্ষত?”
লেখক এই প্রবন্ধে যা বুঝিয়েছেন।
লেখক এই প্রবন্ধে ধর্মের দুইটি রূপ, সত্য ধর্ম এবং কৃত্রিম ধর্ম, এর মধ্যে পার্থক্য অত্যন্ত শৈল্পিক ও দার্শনিক উপায়ে তুলে ধরেছেন। তিনি বিভিন্ন উপমা এবং চিত্রকল্প ব্যবহার করে পাঠকের মনকে জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন। প্রবন্ধটি মূলত ধর্মের অন্তর্নিহিত মূল্যবোধ এবং এর বাহ্যিক রূপের মধ্যে পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করে। লেখকের বক্তব্যের প্রধান দিকগুলো নিম্নরূপ:
১. সত্য ধর্ম বনাম কৃত্রিম ধর্ম
লেখক প্রথমেই কিছু বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে সত্য ও কৃত্রিমের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরেছেন। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিমের মধ্যে যতটা ফারাক, ঠিক ততটাই পার্থক্য সত্য ধর্ম এবং কৃত্রিম ধর্মের মধ্যে।
- সত্য ধর্ম: এটি হৃদয়, আত্মা, এবং গভীর বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে। এটি মানুষের ভেতর থেকে পরিবর্তন আনে, জীবনে উদ্দীপনা সৃষ্টি করে এবং বাস্তবিক অর্থে জীবনের গতিপথ পরিবর্তন করে।
- কৃত্রিম ধর্ম: এটি শুধুমাত্র আচার-অনুষ্ঠান এবং বাহ্যিক আচরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এটি হৃদয় বা আত্মার গভীরে প্রবেশ করে না, বরং শারীরিক ও পার্থিব কাজের খেলা হয়ে থাকে।
২. মুসলিমদের অতীত এবং বর্তমান অবস্থা
লেখক মুসলিমদের প্রাথমিক যুগের সাফল্য এবং পরবর্তী যুগের অবনতির কারণ বিশ্লেষণ করেছেন।
- প্রাথমিক যুগে মুসলিমরা সত্য ধর্মের শক্তি ধারণ করেছিল। তাদের জীবন, কর্ম, এবং বিশ্বাস একসঙ্গে মিলে একটি শক্তিশালী ও উন্নত সমাজ গড়ে তুলেছিল।
- পরবর্তী যুগে এই সত্য ধর্ম হারিয়ে কেবল কৃত্রিম ধর্মের রূপ ধারণ করায় মুসলিম সমাজ দুর্বল ও পরাধীন হয়ে পড়ে।
৩. “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এর প্রকৃত অর্থ
লেখক “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এর মাধ্যমে সত্য ধর্মের প্রকৃতি বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।
- সত্য ধর্মে এটি একটি বিপ্লবী বাক্য। এটি সকল ভুল আর্থিক, সামাজিক ও পার্থিব উপাসনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং শুধুমাত্র আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণের প্রতীক।
- কৃত্রিম ধর্মে এটি শুধুমাত্র একটি বাক্য হয়ে দাঁড়ায়, যার কোনো কার্যকর প্রভাব বা অর্থ থাকে না।
৪. কৃত্রিম ধর্মের সীমাবদ্ধতা
কৃত্রিম ধর্মে:
- নামাজ শুধুমাত্র শারীরিক ব্যায়াম,
- হজ একরকম ভ্রমণ,
- এবং অন্যান্য আচার-অনুষ্ঠান শুধুমাত্র মঞ্চের নাটকের মতো হয়ে দাঁড়ায়।
এর ফলে আত্মা এবং বিশ্বাসের জায়গায় শুধু রীতিনীতি এবং বাহ্যিকতা স্থান পায়।
৫. সত্য ধর্মের শক্তি
লেখক সত্য ধর্মকে এমন এক শক্তি হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যা মানুষের মধ্যে অভূতপূর্ব পরিবর্তন আনতে সক্ষম।
- এটি মানুষকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে, ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে, এবং আত্মত্যাগ করতে শেখায়।
- এটি মৃত আত্মাকে জীবিত করে তোলে এবং দুর্বল মানুষকে শক্তিশালী করে।
- এটি সেই চেতনাশক্তি, যা কর্মে গতি আনে এবং জাগতিক বাধা অতিক্রম করে লক্ষ্য পূরণে সাহায্য করে।
৬. কৃত্রিম ধর্মের ক্ষতিকর দিক
কৃত্রিম ধর্মের অনুসারীরা:
- ধর্মকে নিজেদের সুবিধার জন্য ব্যবহার করে,
- এর প্রকৃত শিক্ষা ভুলে কেবল বাহ্যিক রূপকেই গুরুত্ব দেয়।
এতে ধর্মের মূল শক্তি হারিয়ে যায় এবং এটি সমাজের কোনো কল্যাণে ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়।
৭. বিশ্বাসের রূপান্তরক্ষমতা
লেখক বিশ্বাসকে প্রেমের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সত্যিকারের বিশ্বাস মানুষের চিন্তা, কাজ এবং জীবনের গুণগত পরিবর্তন ঘটাতে পারে। এটি অলসতাকে উদ্দীপনায়, দুষ্টতাকে পবিত্রতায় এবং স্বার্থপরতাকে পরার্থপরতায় রূপান্তরিত করে।
৮. সমাপ্তি: হৃদয়ের আহ্বান
লেখক শেষে নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলেন, যদি কারো কাছে সত্য ধর্মের এক টুকরো পাওয়া যেত, তবে তিনি তা নিজের ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের বিনিময়ে গ্রহণ করতেন। তিনি আক্ষেপ করেন যে অনেকেই সত্য ধর্মের আত্মাকে হারিয়ে কেবল বাহ্যিকতার মোহে আটকে আছেন।
সারমর্ম
লেখক প্রবন্ধে বুঝিয়েছেন,
- সত্য ধর্ম হলো এমন এক বিশ্বাস ও শক্তি যা মানুষের জীবনকে প্রকৃত অর্থে বদলে দিতে পারে। অন্যদিকে,
- কৃত্রিম ধর্ম হলো বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানের মোহ, যা আত্মা এবং হৃদয়ের গভীরে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। এই পার্থক্য অনুধাবন করে সত্য ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করাই লেখকের মূল আহ্বান।