– ড. আহমদ আমীন।
নিরাশা ও আশার মাঝে
প্রতিটি জাতির জীবনে দুটি ধ্বনি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, এবং এদের মধ্যে ভারসাম্য থাকা অপরিহার্য:
- এক ধ্বনি জাতির দুর্বলতা ও ত্রুটিগুলোকে নম্র ও সহানুভূতিশীলভাবে প্রকাশ করে, এবং তা থেকে মুক্তি লাভের আহ্বান জানায়।
- অন্য ধ্বনি জাতির গুণাবলি ও সাফল্যকে তুলে ধরে, এবং এগুলো আরও বাড়ানোর প্রেরণা দেয়।
এই দুই ধ্বনি একত্রে ভারসাম্যপূর্ণ হলে, একটি সুরেলা সংগীত সৃষ্টি হয়। এটি জাতিকে আশাবাদী করে তোলে এবং তাকে অগ্রগতির পথে পরিচালিত করে। এটি এমন এক সুর, যা সেনাবাহিনীর সঙ্গীতের মতো সাহস জাগায়, বিজয়ের আশা জাগিয়ে তোলে। কিন্তু যদি এক ধ্বনি অন্যটির ওপর আধিপত্য বিস্তার করে, তবে সেই সুর বিশৃঙ্খল হয়ে যায়। এটি আত্মাকে অস্থির করে এবং জাতির মধ্যে ফাটল ধরায়।
যেমন, একটি সংগীত যদি সম্পূর্ণ “বেসুরো” হয়, তবে তা কানে বাজে এবং আত্মাকে আহত করে। তাহলে কেমন হবে, যদি একটি জাতির সম্পূর্ণ ভাবধারা এবং প্রচারণা কেবল বেসুরো ধ্বনিতেই পূর্ণ হয়?
পূর্বে একঘেয়েমি এবং হতাশার সুর
দুঃখজনকভাবে, আমাদের পূর্বে একমাত্র ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে, সেটি হলো হতাশা ও নিরাশার সুর। এটি সর্বত্রই শোনা যায়। মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে সাহিত্যিক, সমাজবিজ্ঞানী এবং বিজ্ঞান প্রচারক সবাই একই নিরাশাজনক সুরে কথা বলেন।
১. ধর্মীয় বক্তৃতার নিরাশা:
মসজিদের খুতবাগুলো প্রায়শই একই রকম। ইমামগণ বলেন, যারা তাদের সামনে বসে আছেন, তারা প্রকৃত ঈমানদার নন। তারা পাপ ও ভুলে এতটাই ডুবে গেছেন যে আল্লাহ তাদের শাস্তি দিতে বাধ্য। এই বক্তব্য পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে মানুষ তাদের জন্য আর কোনো আশা দেখতে পায় না। তারা নিজেকে শুধুই আল্লাহর করুণার উপর নির্ভরশীল বলে মনে করে।
২. ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি অবজ্ঞা:
সাহিত্যিকরা বলেন, আরবি ভাষা ও সাহিত্য পিছিয়ে পড়েছে। পশ্চিমা ভাষা ও সাহিত্যই প্রকৃত শিল্প ও জ্ঞানের উৎস। তারা পূর্বের ভাষা ও সাহিত্যের গুণাবলি তুলে ধরতে ব্যর্থ হন। বরং, তারা পূর্বকে পশ্চিমের অনুকরণ করতে বলে।
৩. সমাজবিজ্ঞানীদের সমালোচনা:
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, পূর্বে কোনো সৌন্দর্য নেই। প্রকৃতি, সংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রার প্রতিটি দিক তাদের মতে পশ্চিমের তুলনায় অনেক নিচু। তাদের ধারণা, আল্লাহ যেন সৌন্দর্যের সবটুকু পশ্চিমকে দিয়েছেন এবং পূর্বকে বঞ্চিত করেছেন।
৪. বিজ্ঞান ও জ্ঞানের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব:
বিজ্ঞান প্রচারকদের মতে, আরবি বিজ্ঞান ও দর্শনের কোনো মূল্য নেই। এগুলো কেবল ইতিহাসের জন্য প্রাসঙ্গিক। তারা এ কথায় জোর দেন যে পূর্ব যদি উন্নতি করতে চায়, তবে তাকে পুরোটাই পশ্চিমা কৃষ্টিতে রূপান্তরিত হতে হবে।
জাতীয় আত্মবিশ্বাস ও গৌরবের অভাব
এই হতাশাজনক সুর জাতির জন্য তার সকল ত্রুটির চেয়ে বেশি ক্ষতিকর। কারণ, একটি জাতি তার অতীতের গৌরব এবং অর্জনের উপর নির্ভর করেই ভবিষ্যতে অগ্রসর হয়। জাতির মধ্যে যদি আত্মবিশ্বাস না থাকে, তবে তা কখনোই উন্নতির পথে হাঁটতে পারবে না।
আল্লাহ বলেন:
“তোমরা সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি, মানবতার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে” (সূরা আল ইমরান: ১১০)।
এটি একটি ইতিবাচক প্রেরণা, যা একটি জাতিকে আশাবাদী করে তোলে এবং তাদের ভবিষ্যতের জন্য কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে।
পশ্চিমা দেশগুলো তাদের জাতীয় গানে এবং চিন্তায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বকে তুলে ধরে। যেমন, জার্মান জাতীয় সংগীতে বলা হয়: “জার্মানি সবার ওপরে।” এই ধরনের গৌরব জাতির মধ্যে আশার সঞ্চার করে এবং কাজের প্রেরণা দেয়।
আশাবাদ ও ইতিবাচকতার গুরুত্ব
যদি কোনো ব্যক্তি ভুল করে এবং তাকে দেখানো হয় যে তার ভুল সংশোধন করা সম্ভব, তবে সে তা সংশোধন করবে। কিন্তু, যদি তাকে বলা হয় যে তার ভুল ক্ষমার অযোগ্য, তবে সে বারবার ভুল করতে থাকবে।
সমাজের পথভ্রষ্ট মানুষ যদি অনুভব করে যে তারা ফিরে আসার সুযোগ পাবে এবং সমাজ তাদের গ্রহণ করবে, তবে তারা নিজেদের সংশোধন করতে পারে। কিন্তু যদি তাদের সবসময় অবজ্ঞা করা হয়, তবে তারা আরো গভীরতর অবনমনের পথে চলে যাবে।
শেষ কথা:
পূর্বের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এই নিরাশার সুর, যা তার প্রচারকরা ছড়াচ্ছেন। এটি জাতির আত্মবিশ্বাস ভেঙে দিচ্ছে এবং তাদের মনোবল দুর্বল করে দিচ্ছে।
প্রিয় প্রচারকগণ!
আপনারা এই একঘেয়ে ও হতাশাজনক সুর থামান। একটি নতুন সুর নিয়ে আসুন, যা আশার সুর বাজাবে, জাতির মধ্যে কর্মস্পৃহা সৃষ্টি করবে এবং তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়াবে। কোনো ত্রুটি তুলে ধরলে তার সঙ্গে সাফল্যের কথাও বলুন। আমাদের শুধু ধ্বংসের গল্প শোনাবেন না, বরং দেখান কোথায় নির্মাণ হচ্ছে।
এই প্রবন্ধে লেখক যা বুঝিয়েছেন
প্রবন্ধের লেখক সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র—ধর্ম, সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান, ও বিজ্ঞান—সবখানেই যে নিরাশা এবং হতাশার ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে, সেটি তুলে ধরেছেন এবং এর নেতিবাচক প্রভাব বিশ্লেষণ করেছেন। লেখকের মূল বার্তা হলো: একটি জাতি শুধুমাত্র তার দুর্বলতা ও ব্যর্থতার দিকে তাকিয়ে উন্নতি করতে পারে না। বরং, তাকে তার গুণাবলি, সম্ভাবনা, এবং অর্জনগুলোকে সামনে রেখে আশাবাদী হতে হবে এবং ভবিষ্যতের জন্য কাজ করতে হবে।
প্রবন্ধে দুটি প্রধান ধ্বনির কথা বলা হয়েছে:
১. নিরাশার ধ্বনি:
এটি একটি নেতিবাচক সুর, যা সমাজের বিভিন্ন স্তরে উচ্চারিত হচ্ছে:
ধর্মীয় খুতবা: ইমামগণ সব সময় মানুষের পাপ ও দুর্বলতার কথা বলেন এবং তাদের ঈমানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন।
সাহিত্য: সাহিত্যিকরা পূর্বের ভাষা ও সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করেন এবং পশ্চিমের অনুকরণ করার আহ্বান জানান।
সমাজবিজ্ঞান: সমাজবিজ্ঞানীরা পূর্বের সংস্কৃতি, প্রকৃতি ও সমাজব্যবস্থাকে সবদিক থেকেই পশ্চিমের তুলনায় নিম্নতর বলে মনে করেন।
বিজ্ঞান: বিজ্ঞান প্রচারকরা পূর্বের জ্ঞান ও গবেষণাকে অবমূল্যায়ন করেন এবং পশ্চিমা চিন্তা ও কৃষ্টিকে একমাত্র উত্তরণের পথ হিসেবে দেখান।
এই একপেশে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি জাতির আত্মবিশ্বাস ও মনোবলকে ভেঙে দিচ্ছে। যখন একটি জাতি সবসময় নিজেদের ব্যর্থতার দিকে তাকায় এবং গৌরব বা সাফল্যের কোনো আলো দেখতে পায় না, তখন তা ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়।
২. আশার ধ্বনি:
লেখকের মতে, একটি জাতির উন্নতির জন্য তাকে আশাবাদী হতে হবে এবং তার ইতিবাচক দিকগুলোকে তুলে ধরতে হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেছেন:
“তোমরা সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি, মানবতার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে” (সূরা আল ইমরান: ১১০)।
এটি একটি ইতিবাচক বার্তা, যা একটি জাতিকে তার সাফল্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ভবিষ্যতে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায়।
লেখকের বার্তা:
- সমাজে শুধু ত্রুটি বা ব্যর্থতার কথা বললে মানুষ আশাহীন হয়ে পড়ে এবং নিজেদের উন্নতির চেষ্টা বন্ধ করে দেয়।
- সমাজের নেতিবাচকতা দূর করতে হলে ত্রুটি তুলে ধরার পাশাপাশি সাফল্যের কথাও বলতে হবে।
- মানুষ যদি অনুভব করে যে তারা ভুল সংশোধনের সুযোগ পাবে এবং সমাজ তাদের গ্রহণ করবে, তবে তারা সংশোধনের চেষ্টা করবে। কিন্তু যদি সবসময় অবজ্ঞা করা হয়, তারা আরো গভীর অবনতির দিকে যাবে।
উপসংহার:
লেখক সমাজের প্রচারকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন—এই একঘেয়ে ও হতাশাজনক সুর থামান। একটি নতুন সুর আনুন, যা মানুষকে আশাবাদী করবে, তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস বাড়াবে এবং কাজের স্পৃহা জাগাবে। কোনো জাতির উন্নতির জন্য সমালোচনা যেমন প্রয়োজন, তেমনি তার সাফল্যের গল্পও শোনাতে হবে, যাতে তারা আরও উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারে।